খানকা (সুফি ধর্মের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র) পরিচালনায় মাল খরচ বা আর্থিক ব্যয় প্রয়োজনীয় হওয়ার পেছনে ধর্মীয়, সামাজিক ও ব্যবহারিক বেশ কিছু কারণ রয়েছে। ইসলামী সুফিবাদে খানকাগুলো শুধু আধ্যাত্মিক চর্চার স্থান নয়, বরং সমাজসেবা ও সম্প্রদায়ের প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিচে এর প্রধান কারণগুলো বিশ্লেষণ করা হলো:
১. আতিথেয়তা ও সেবা (ضيافة)
সুফি খানকাগুলোতে সর্বদা ভ্রমণকারী দরবেশ, ফকির ও সাধকদের জন্য খাবার, থাকার ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় সুবিধা দেওয়া হয়। এই ঐতিহ্য ইসলামের “মেহমানদারি” (আতিথেয়তা) নীতির উপর ভিত্তি করে। রাসূল (সা.) বলেছেন,
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস করে, সে যেন মেহমানের সম্মান করে।” (বুখারি)
এ কারণে খানকার রোজকার খরচে রান্না, আশ্রয় ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনা বাধ্যতামূলক।
২. গরিব ও যাত্রীদের সাহায্য
অনেক খানকা গরিব, অসহায় ও পথিকদের জন্য মুক্ত খাবার (লঙ্গর) বা আর্থিক সহায়তা দেয়। সুফি সাধকরা বিশ্বাস করেন, সম্পদ বণ্টন করলে আল্লাহর রহমত বৃদ্ধি পায়। যেমন:
- দাতব্য চাল-ডাল, কাপড় বা ঔষধ বিতরণ।
- মুসাফিরখানা বা হাসপাতাল পরিচালনা (ঐতিহাসিকভাবে অনেক খানকায় চিকিৎসাসেবা ছিল)।
৩. ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও শিক্ষা
খানকায় নিয়মিত জিকির-আজকার, সম্মেলন, ওরশ (সুফি সাধকের মৃত্যুবার্ষিকী) ইত্যাদি আয়োজনে অর্থ ব্যয় হয়। এছাড়া:
- কুরআন, হাদিস ও সুফি সাহিত্য শিক্ষার ব্যবস্থা।
- বই, মাদ্রাসা বা লাইব্রেরি রক্ষণাবেক্ষণ।
৪. স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণ
খানকার ভবন, মসজিদ, সমাধি বা প্রার্থনা কক্ষের মেরামত, বিদ্যুৎ-পানি বিল ইত্যাদি নিয়মিত খরচ প্রয়োজন। কিছু ঐতিহাসিক খানকা (যেমন: বাংলাদেশের শাহজালাল (রহ.)-এর দরগাহ) পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত, যেখানে নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে বিনিয়োগ করতে হয়।
৫. সুফি ঐতিহ্য ও শৃঙ্খলা
সুফি তরিকার (যেমন: কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া) নির্দেশনা অনুযায়ী, মুরিদান (শিষ্য) ও পীর-মাশায়েখদের ভরণপোষণ খানকার দায়িত্ব। ইসলামে “ফি সাবিলিল্লাহ” (আল্লাহর পথে ব্যয়) এর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে:
“তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করো… আর যা কিছু ভালো কাজ আগে পাঠিয়ে দেবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে।” (সুরা বাকারা, ২:১১০)
৬. স্বনির্ভরতা ও ওয়াকফ
অনেক খানকা ওয়াকফ সম্পত্তি (ধর্মীয় ট্রাস্ট) থেকে আয় করে, যা জমি, দোকান বা কৃষিজমির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তবে এসব সম্পত্তি রক্ষা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ প্রয়োজন।
সতর্কতা: অপচয় নয়, ভারসাম্য
ইসলামে অপচয় (ইসরাফ) নিষিদ্ধ। তাই খানকার অর্থ ব্যয়ে সততা ও জবাবদিহিতা জরুরি। সুফিরা বিশ্বাস করেন, সম্পদ হলো আমানত, যা সমাজের সেবায় ব্যবহার করতে হবে।
উপসংহার
খানকায় মাল খরচের মূল উদ্দেশ্য হলো আধ্যাত্মিকতা ও সমাজসেবার সমন্বয় করা। এটি শুধু আচার-অনুষ্ঠান নয়, বরং ইসলামের “ইহসান” (সদাচরণ) ও “ইত্তেবায়ে সুন্নাহ” (সুন্নতের অনুসরণ) এর প্রতিফলন। যেমন হযরত আবু বকর (রা.) বলতেন:
“আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ব্যয় করো, তবে জেনেশুনে করো।”